অথ শ্বেত শিমুল কথা।
আমাদের বাড়িতে আগে খুব ঘটা করে গোটাসেদ্ধ হতো। তার জন্য বড় বড় সব বাসন ছিল। কোনো কোনো বার রান্না শেষ হতে রাত দুটোও বেজে যেত। পরেরদিন সক্কাল থেকে সেই ঠান্ডা খাবার বিতরণের পালা শুরু হয়ে যেত।
কি তৃপ্তি করে খেত সবাই। দ্বিতীয়বারও চেয়ে নিয়ে যেত কেউ কেউ।
একবার হলো কি, রান্না বসানোর আগে বেগুনগুলি ফালি করতে গিয়ে দেখা গেল, অন্য আনাজের তুলনায় বেগুন কম। আরও ক'টি বেগুন হলে নাকি ভালো হতো।
সকালে রাশি রাশি বাজার করেছি। তুলতুলে নরম, লম্বা লম্বা, বেগুনি রঙের ঝকঝকে বেগুন এনেছি এত্তো। তবু কম পড়লো!
তখন সরস্বতী পূজার ধকল সামলে সবে একটু বসেছি, হুকুম হলো, ক'টা বেগুন নিয়ে এসো।
পাড়ার লোকে তাঁর রান্না খেয়ে প্রশংসা করবে সেই উত্তেজনা তখন তাঁর গলায়।
কাজেই, পারবো না বলার সাধ্য নেই। ব্যাগ নিয়ে, বাইক নিয়ে বেরুলাম। কিন্তু তখন অতো রাতে কি আর বেগুন পাওয়া যায়! গোটার বাজার আগের দিনই বা বড়জোর সেদিন সকালেই শেষ হয়ে গেছে। কাজেই বাজার তখন ফাঁকা।
শেষে দূরের বড় বাজারে গিয়ে পাওয়া গেলো বেগুন। কিন্তু সে বেগুন বেগুনী নয়, সবুজ বেগুন। নিরুপায় হয়ে এবং সাত পাঁচ ভেবে তাইই নিয়ে নিলাম চাড্ডি। কিন্তু ওই বেগুনই যে আমার দুঃখের কারণ হবে তা কে জানতো!
শুনলাম এবং জানলাম, আমি বড়ই হয়েছি, বুদ্ধি কিছুই হয়নি, সবুজ বেগুনের খোসা মোটা, তা দিয়ে গোটাসেদ্ধ হয়না ইত্যাদি।
কে জানতো অত কথা!
পরে অবশ্য রান্নার গুণেই হোক বা খোসামোটা বেগুনের জন্যই হোক গোটাসেদ্ধ খেয়ে সবাই ধন্য ধন্য করেছিল।
সে গল্প থাক। বেগুনসদৃশ রূপসীর অন্য কথা বলি।
সেদিন সকালে বোটানিক্যাল গার্ডেন হাঁটাহাঁটি করে ফেরার পথে, বিদ্যাসাগর সেতুর গায়েই একটি গাছে ঝুলন্ত সবুজ ফলগুলি দেখে সেই সবুজ বেগুনের কথা মনে পড়তেই বাইক থামিয়ে পিছন ফিরে তাকালাম। তাঁর একটুখানি হাসিতে বুঝলাম, তাঁর সব মনে আছে, সেই গোটাসেদ্ধ, সেই সবুজ বেগুন।
সে যাক। এই সবুজ ফলের কথা বলি।
ফলগুলি শ্বেত শিমূলের ফল। এখন কচি, তাই সবুজ এবং ছোট।
লাল শিমূলের মতো এও পাতাঝরা গাছ।
বসন্তের শুরুতেই থোকা থোকা কুঁড়ি হয়ে সাদা ফুলে গাছ ভরে যায়। কত পতঙ্গ আসে তখন, কত পাখি আসে। যে যার মতো আহরণ করে যায়। কলকাকলিতে গাছের মাথায় তখন যেন মেলা বসে যায়।
মাসখানেকের মধ্যেই এই সবুজ ফলগুলি পেকে খয়েরী হয়ে যাবে। তারপর এক এক করে ঝরে পড়বে।
কলকাতার পথে পথে, বিদ্যাসাগর সেতুর এপ্রোচ রোডগুলির ধারে ধারে শুকনো সেই ফল হামেশাই পড়ে থাকতে দেখি। মাটিতে পড়ে অনেক ফল ফেটে গেলে দেখা যায় ভিতরে নরম তুলতুলে ঈষৎ হলুদ রঙের তুলো, থোকায় থোকায় ফলের দেওয়ালে সাজানো আছে।
আমি কখনো কখনো কুড়িয়ে নিয়েছি সে ফল, সযত্নে স্পর্শ করেছি তুলো, তারপর আবার যত্ন করেই পথের ধারে রেখে দিয়েছি। আমি জানি এগুলি সংগ্রহ করার লোক আছে। এ তাদের ভীষণ কাজের জিনিস। এতে অধিকার তাদেরই।
শ্বেত শিমুলকে পরিভাষায় বলে সিল্ক কটন। এর তুলোয় রেশমী স্পর্শ আছে। হাতে নিয়ে চাপ দিলে কেমন পিছলে যাওয়া অনুভূতি হয়। কোনো কোনোটিতে আবার বিশেষ গন্ধও থাকে। সেই গন্ধের জন্যই নাকি একে সহজে পোকায় আক্রমণ করতে পারেনা।
শ্বেত শিমুল আদতে মেক্সিকোর গাছ। ক্রমে তা এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এখন দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় বিশেষ করে জাভা, ফিলিপিন্স, মালয়েশিয়ায় সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। আর ভারত তো আছেই।
এর ইংরাজি নাম Silk cotton বা Kapok বা Java kapok. বৈজ্ঞানিক নাম Ceiba pentandra.
মেক্সিকোর ফলগুলি আকারে অনেক বড়, তাই তুলোও অনেক বেশি। এশিয়ার ফল ছোট।
শ্বেত শিমুল বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ গাছ। ভারসাম্য রাখতে এবং গাছের ভার সামলানোর জন্য গোড়ার কাছে গুঁড়ি কয়েকটি কুটুরিতে বিভক্ত হয়ে অনেকখানি জায়গা জুড়ে থাকে। পরিভাষায় তাকে বাটরেস (buttress) বলে।
স্পর্শে পিচ্ছিল বলে শ্বেত শিমুলের তুলোয় সুতো বোনা কঠিন। এ দিয়ে তোষক, বালিশ, নরম পুতুল ইত্যাদি তৈরি হয়।
এই তুলো ভীষণ হালকা কিন্তু সহজে জলে ভেজে না। তাই আগেকার দিনে লাইফ বেল্ট তৈরি করতে এর ব্যাপক ব্যবহার ছিল।
শ্বেত শিমুলের বীজের তেল একটি biofuel.
ফুলের নাম- শ্বেত শিমুল
বৈজ্ঞানিক নাম- Ceiba pentandra(Syn. Bombax pentadru)
পরিবার- Malvaceae
উপ-পরিবার- Bombacoideae
অন্যান্য নাম- White silk cotton tree, Kapok, Ceiba, Safed shimul(hindi)
রেইনফরেস্টের প্রকান্ড গাছ (Giant tree of rainforest) শ্বেত শিমুল এর আদি নিবাস মেক্সিকো, মধ্য-আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান অঞ্চল, দক্ষিণ আমেরিকার উত্তরাংশ থেকে পশ্চিম আফ্রিকার উষ্ণপ্রধান অঞ্চল। গাছটি প্রায় ২৩০ ফুট লম্বা হতে পারে এবং মাটিতে ঠেস দেয়া কান্ডের ব্যাস প্রায় ১০ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। প্রাকৃতিকভাবে আমাদের দেশে খুব বেশি দেখা না গেলেও বিভিন্ন পার্ক বা উদ্যানে শ্বেত শিমুল গাছের দেখা পাবেন।
বসন্তে শ্বেত শিমুল গাছে ফুল ফোটে। ফুল খুব ছোট, সাদা রঙের এবং এরা গাছের পাতার সাথে এমনভাবে মিশে থাকে যে দূর থেকে ফুল দেখার কোনো উপায় নেই। গাছের নিচে গেলে দেখতে পাবেন ঝরা ফুলের মেলা। রমনা পার্কের শ্বেত শিমুল গাছটা দেখে আপনার জাতীয় স্মৃতিসৌধের কথা মনে পড়ে যেতে পারে। শ্বেত শিমুল গাছে ৫-৯টি পত্রিকা নিয়ে করতলাকার বিন্যাসে পাতা থাকে, যা ৮ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। প্রায় ৬ ইঞ্চি লম্বা ফলের ভেতর তুলায় জড়ানো বীজ থাকে। এই তুলার জন্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে বাণিজ্যিকভাবে শ্বেত শিমুল গাছ লাগানো হয়। তাই এই গাছকে java cotton, java kapok, silk-cotton, samauma নামেও ডাকা হয়। বীজের তেলের আয়োডিন ভ্যালু ৮০-১০০। ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ায় বাণিজ্যিকভাবে বীজের তেল উৎপাদন করা হয়। বায়োফুয়েল আর রঙ প্রক্রিয়াজাতকরণে তেল কাজে লাগে। গাছের বাকল ভেষজ ঔষধে কাজে লাগে। আর মায়ান মিথ অনুযায়ী, শ্বেত শিমুল তাদের পবিত্র বৃক্ষ। গুয়াতেমালা ও পোর্টো রিকোর জাতীয় বৃক্ষও শ্বেত শিমুল।
ছবি- নেট
nice writing
ReplyDelete